গীতাঞ্জলি
রবীন্দ্র রচনাবলী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অন্তর মম বিকশিত করো
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
আকাশতলে উঠল ফুটে
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে
আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়
আজ বারি ঝরে ঝর ঝর
আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
আজি শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
আজি গন্ধবিধুর সমীরণে কার সন্ধানে ফিরি বনে বনে
আনন্দেরই সাগর থেকে
আবার এরা ঘিরেছে মোর মন
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
আমার নয়ন-ভুলানো এলে
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
আমার এ গান ছেড়েছে তার
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু
আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে
আমার মাঝে তোমার লীলা হবে
আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে
আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
আমার একলা ঘরের আড়াল ভেঙে
আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে সত্য হবে
আমারে যদি জাগালে আজি নাথ
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবাপানে
আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান
আর নাই রে বেলা নামল ছায়া
আর আমায় আমি নিজের শিরে বইব না
আরো আঘাত সইবে আমার
আলোয় আলোকময় করে হে
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল
আসনতলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে
এই করেছ ভালো, নিঠুর, এই করেছ ভালো
এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ
এই তো তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ
এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে
একটি একটি করে তোমার পুরানো তার খোলো
একটি নমস্কারে, প্রভু একটি নমস্কারে
একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে
একা আমি ফিরব না আর
এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে
এসো হে এসো সজল ঘন বাদলবরিষনে
ওই যে তরী দিল খুলে
ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা
ওগো মৌন, না যদি কও না-ই কহিলে কথা
ওরে মাঝি ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি
কত অজানারে জানাইলে তুমি
কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি
কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে
কে বলে সব ফেলে যাবি
কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো
কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী
গান গাওয়ালে আমায় তুমি কতই ছলে যে
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি বাহির মনে
গাবার মতো হয় নি কোনো গান
গায়ে আমার পুলক লাগে
চাই গো আমি তোমারে চাই
চিত্ত আমার হারাল আজ মেঘের মাঝখানে
চিরজনমের বেদনা, ওহে চিরজীবনের সাধনা
ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে
ছিন্ন করে লও হে মোরে
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ
জগৎ জুড়ে উদার সুরে
জননী তোমার করুণ চরণখানি
জানি জানি কোন্ আদি কাল হতে
জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো
জীবনে যত পূজা হল না সারা
জীবনে যা চিরদিন রয়ে গেছে আভাসে
জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাই
জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে
ডাকো ডাকো ডাকো আমারে
তব সিংহাসনের আসন হতে
তাই তোমার আনন্দ আমার পর
তারা তোমার নামে বাটের মাঝে
তারা দিনের বেলা এসেছিল
তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে
তুমি আমার আপন তুমি আছ আমার কাছে
তুমি যখন গান গাহিতে বল
তুমি যে কাজ করছ আমায় সেই কাজে কি লাগাবে না
তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ লহো
তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ
তোমার দয়া যদি চাহিতে নাও জানি
তোমার প্রেম যে বইতে পারি এমন সাধ্য নাই
তোমার সাথে নিত্য বিরোধ আর সহে না
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর
তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি
দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও
দিবস যদি সাঙ্গ হল না যদি গাহে পাখি
দুঃস্বপন কোথা হতে এসে
দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে
দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে
দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে
ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়
ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি
নামটা যেদিন ঘুচাবে নাথ
নামাও নামাও আমায় তোমার চরণতলে
নিন্দা দুঃখে অপমানে যত আঘাত খাই
নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা
নিশার স্বপন ছুটল রে এই ছুটল রে
পারবি না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে
প্রভু আজি তোমার দক্ষিণ হাত
প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে
প্রভুগৃহ হতে আসিলে যেদিন বীরের দল
প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে
প্রেমের হাতে ধরা দেব তাই রয়েছি বসে
ফুলের মতন আপনি ফুটাও গান
বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি
বিপদে মোরে রক্ষা করো
বিশ্ব যখন নিদ্রামগন গগন অন্ধকার
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক্ পড়ে
ভেবেছিনু মনে যা হবার তারি শেষে
মনকে আমার কায়াকে আমি একেবারে মিলিয়ে দিতে
মনে করি এইখানে শেষ কোথা বা হয় শেষ
মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে
মানের আসন আরামশয়ন নয় তো তোমার তরে
মুখ ফিরায়ে রব তোমার পানে
মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে
মেনেছি, হার মেনেছি
যখন আমায় বাঁধ আগে পিছে
যতকাল তুই শিশুর মতো রইবি বলহীন
যতবার আলো জ্বালাতে চাই
যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু
যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে
যা দিয়েছ আমার এ প্রাণ ভরি
যাত্রী আমি ওরে পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে
যাবার দিন এই কথাটি
যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে
যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
যেন শেষ গানে মোর সব রাগিণী পূরে
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
লেগেছে অমল ধবল পালে
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে
শেষের মধ্যে অশেষ আছে এই কথাটি মনে
সংসারেতে আর-যাহারা আমায় ভালোবাসে
সবা হতে রাখব তোমায় আড়াল ক’রে
সভা যখন ভাঙবে তখন শেষের গান কি যাব গেয়ে
সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর
সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে
সে যে পাশে এসে বসেছিল
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
হেথা যে গান গাইতে আসা আমার
হেথায় তিনি কোল পেতেছেন
হেরি অহরহ তোমারি বিরহ